একান্ত ব্যক্তিগত একরাশ শূণ্যতা

একান্ত ব্যক্তিগত একরাশ শূণ্যতা

রিন্টু সাহা

হয়তো আমার এ লেখা সময়োচিত নয়!
তবু লিখছি,
 কেননা অন্য সময়ে আজকের অনুভূতি বদলে যেতে পারে।
আমরা এমন এক সময় প্রবাহের মধ্য দিয়ে চলছি
যখন প্রতিদিন ই শোক সংবাদ সহ্য করতে হচ্ছে,
মৃত্যভয় গ্রাস করছে স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ।
দুই বছর ধরে টানা মৃত্যু মিছিল চলছে দেশজুড়ে
সারা পৃথিবীতেও একই অবস্থা।
ভয়ানক পরিস্থিতির শিকার মানবসমাজ।
একশ বছর আগে প্রায় এমনই এক অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
সেই ইতিহাস আবার ফিরে এসেছে নব উদ্যমে।
এবার আরো ভয়াবহ।

এমন সময় যখন চলছে তখন
ব্যক্তিগত শোক তেমন ছিল না।
তবে এখানে বলে রাখতে হবে কবি মন কিন্তু
যেকারো মৃত্যুতে শোকাতুর হয়,
পৃথিবীর সবাই তার আত্মার আত্মীয়।
পক্ষ প্রতিপক্ষ বলে কেউ নেই
তাই কবির মন যুদ্ধ বিরোধী।

সত্যি বলতে শেষ বার
আজকের মত আঘাত পেয়েছিলাম
পাঁচ বছর আগে, মায়ের মৃত্যুতে।
এমন কষ্ট, বুকের মধ্যে দুরন্তপনা
আজ আবারো ফিরে এলো।

শেষ পাঁচ ছয় বছর ধরে একটি বিড়াল
আমাদের বাড়িতে প্রায় পোষ্য হয়ে উঠেছিল।
পাড়ায় থাকতো, এ বাড়ি সে বাড়ি ঘুরতো
কিন্তু আমাদের বাড়িকে নিজের বাড়ি মনে করতো।
আমিও প্রশ্রয় দিতাম, ভালোবাসতাম।
তিন বছর আগে আমার দোতালা ঘরের চকির নিচে বাচ্চা দিয়েছিল।
সেই প্রথমবার আমার নজরে পরে ভালোমত।
নইলে পাড়ায় তো কত কুকুর বিড়াল থাকে,
আমরা কয়জনের খোঁজ খবর রাখি ঠিকমত!
সেটা হয়তো সম্ভবও নয়।
মানুষ নিজের চিন্তাই ঠিকঠাক করে উঠতে পারে না, আবার কুকুর বিড়াল!
যাইহোক সেবার তিনটি বাচ্চা অনেক আদর পেয়ে বড় হয়।
বড় হলে বাড়ির পাশে ছেড়ে দেই ওদের।
চোখে চোখেই থাকে।
মা বিড়াল টা দিনে বেশ কয়েকবারই আসতো ঘরে খাবার এর জন্য।
কখনো এমনি শুয়ে থাকত এসে।
ঠাকুমা দেখলেই তারিয়ে দিত।
আবার ঠিক চলে আসতো।
বাড়ির সব দরজা জানালা ওর চেনা।
অবাধ বিচরণ।

আবার আর একবার পাশের বাড়ি বাচ্চা দেয় চারটে।
একটু বড় হতেই মুখে করে নিয়ে হাজির আমার দোতালা ঘরে।
কি মারাত্মক কঠিন ভাবে মুখে করে বাচ্চা নিয়ে পাঁচিলে উঠে
সেখান থেকে পাশের বাড়ির ছাঁদে উঠে 
লাফিয়ে আমার জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকতো।
আমার পাশের বাড়ি একতলা, আমাদের দোতালা।
একতালা ছাঁদ থেকে আমার ঘরে আসতো জানালা দিয়ে।
সেই চারটে বাচ্চা আমার ঘরেই বড় হয়েছে।
সারাদিন এ ঘর সে ঘর ঘুরতো।
কত উৎপাত।
বাড়িতে ওদের জন্য কম বকা খাইনি।
আমার জানালা খোলা রাখতাম সব সময় বড় বিড়াল টা যেন ঢুকতে পারে।

এমন করেই সময় পেরোয়।
বিড়াল টা পরিবারের নিত্য সঙ্গী হয়।
ওর বাচ্চারাও।
আর আমি বাড়িতে রোজ বকা খাই, তাও ভালোবাসি।

বিড়াল সারাদিন এদিক ওদিক ঘোরে।
খাবার খোঁজে।
আমাদের বাড়ির খাবার সময় ওর মুখস্থ।
ঠিক এসে হাজির।
ও শুধু মাছের কাঁটা আর মাছ খায়।
আর কিছুই রোচেনা।
দিন চলছে এমনি।
এবারের বাচ্চাগুলোও বড় হতে থাকে।
বাচ্চা গুলো লোকালয় ভাগ করে নেয়।
একজন মায়ের মতই দেখতে হুবহু।
একসাথে খাবার খায় এসে।
সে এখনো আসে রোজ।

মা বিড়াল মাস খানেক আগে আবার বাচ্চা দেই চারটি
আমাদের বাড়ির পাশে, গলিতে।
এবার আর আমার ঘরে বাচ্চা গুলো নিয়ে আসেনি।
গলিতেই বড় হচ্ছে।
মা বিড়াল যেমন আসতো ঘরে তেমনি আসতে লাগলো।

হঠাৎ,
কয়েকদিন ধরে বিড়াল টা আসছিল না।
আমি ভেবেছিলাম বাড়িতে মাছ হচ্ছে না, দরজা বন্ধ তাই হয়তো দেখিনা।
কিন্তু তিন চার দিন যেতেই খোঁজ করি।
জানতে পারি বিড়াল টা আহত, কেউ কামড়েছে পেটে।
খুব কষ্ট পাচ্ছে। 
আশেপাশের বাড়িতে ঢুকে শুয়েছিল।
শোনামাত্র পাগলের মত খুঁজি,
 চিকিৎসা করবো বলে।
কোথাও পাইনা খুঁজে।
অনেকজনকে বলে রাখি তারা দেখলে যেন জানায় আমায়।

দুই দিন পর আজ শুনি মারা গেছে বিড়াল টি।
দুটো বাড়ির পর এক গলিতে শুয়ে রয়েছে মরে।
প্রচন্ড কষ্টে দেখতে যাইনি প্রথমে।
ওর মৃত অবস্থা দেখতে পারবোনা ভাবছিলাম ঘরে বসে।
এদিকে ওর বাচ্চা গুলো আশেপাশের ঘুরঘুর করছে জানালা দিয়ে দেখি।

অনেকক্ষণ বাকরুদ্ধ থাকার পর,
আমি আর আমার ভাগনা মৃত বিড়াল দেখতে যাই।
দেখে এসে বাড়ি থেকে কোদাল আর একটা বড় ব্যাগ নিয়ে 
মৃত বিড়াল কে কোদাল দিয়ে তুলে ব্যাগে ভরে
বাড়ি থেকে অনতিদূরে বাঁশ বাগানের কাছে কবর দিয়ে আসি।
মানুষ ব্যতীত অন্য কোনো প্রাণীর মৃত্যু এত কষ্ট দেইনি আগে,
যাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ ঘটেছে আমার।

মানুষ ওদের কষ্ট বোঝে হয়তো,
 তাই প্রাচীন কাল থেকেই বেশ কিছু প্রাণী 
গৃহপালিত বা মনুষ্য পল্লীতে মানুষের সাথে মিশে আছে।

এখনো ওই মৃত মা বিড়াল এর বাচ্চা গুলো ছোট।
খুঁজছে মা কে।
ওরা অপেক্ষা করছে মায়ের।

আর এদিকে আমার থেকে থেকে বিগত দিনের সব দৃশ্য
টুকরো টুকরো করে মনে পরছে।
যেদিন ভোটের ফলাফল বেড়োয়,
ওই দিন আদর করতে গিয়ে ওর নখের আঁচড় লেগেছে পায়ে আমার,
রক্ত বেড়িয়ে গেছিল অল্প।
আরো কত ঘটনা,
আমি যখন ভাত খেতাম, পায়ের কাছে বসে থাকতো।
কিছুখন পর পর অস্তির হয়ে এদিক ওদিক ঘুরতো।
লাফিয়ে চেয়ারে উঠে যেত।
সারা বাড়ি জুড়ে ওর স্মৃতি,
হাজার।

জানি পৃথিবীর মানুষের এখন বড় অসহায় অবস্থা।
মানুষ মরছে প্রতিদিন অসংখ্য।
আশায় সবাই একদিন মৃত্যুর রথ থামবে।
তবে যাদের আমরা হারাই, ওরা স্মৃতিজুড়ে থেকে যাবে।
যারা বেঁচে থাকব তাদের বাঁচার তাগিদেই বাঁচতে হবে।

একরাশ হতাশা বুকে নিয়েও নিজেকে তো বাঁচতে হবে।

(কোনোদিন ভাবিনি বিড়ালটি নিয়ে লিখব বলে।
ওর মৃত্যু বাধ্য করলো লিখতে।
এখন বুঝতে পারছি মনের কতটা জায়গাজুড়ে থেকে যায়
অবলা প্রাণীরা।)

একটা বিড়ালের মৃত্যু যদি আমায় এত ভাবাতে পারে,
উদ্বেলিত করতে পারে, কষ্ট দিতে পারে।
 তবে নিশ্চয়ই মানুষের মৃত্যু 
আরো বেশি উদ্বেগের।
মারাত্মক কষ্টের।
আর এখন তো মৃত্যু প্রবাহ চলছে মানুষের।
দেশহিতকারী নেতৃত্বগন নিশ্চিত উদ্বিগ্ন।
তবে কেন চিকিৎসা পরিসেবা দিতে পারছেনা তাঁরা?

আমার একান্ত ব্যক্তিগত একরাশ শূণ্যতার ভীরেও 
এই প্রশ্ন মনে উঁকি দেওয়া স্বাভাবিক নয় কি?

 



Comments

Popular posts from this blog

আজকের ছাত্র যুবা